ভগবানের সংজ্ঞা:-
ভগবানের একটি সরল সংজ্ঞা হচ্ছে : 'জন্মাদাস্য য্তঃ' - "যাঁর থেকে সমস্ত প্রকাশিত হয়" (ভা: 1/1/1)৷
'ভগবান' শব্দটি সংস্কৃত, এবং এর অর্থ বিশ্লেষণ করেছেন ব্যাসদেবের পিতা পরাশর মুনি- "(১) সমগ্র ঐশ্বর্য (ধনসম্পদ), (২) সমগ্র বীর্য (শক্তিমত্তা), (৩) সমগ্র য্শ, (৪) সমগ্র শ্রী (সৌন্দর্য, রূপবত্তা), (৫) সমগ্র জ্ঞান ও (৬) সমগ্র বৈরাগ্য যাঁর মধ্যে পূর্ণ-রূপে বর্তমান, সেই পরম পুরুষ হচ্ছেন ভগবান ৷" 'ভগ' শব্দের অর্থ ছয়টি ঐশ্বর্য (ষড়ৈশ্বর্য ) এবং 'বান' শব্দের অর্থ যুক্ত বা সমন্বিত৷ যেমন জ্ঞানবান অর্থ জ্ঞান-সমন্বিত, ধনবান শব্দের অর্থ ধন-সমন্বিত, তেমনি ভগবান শব্দের অর্থ যিনি সম্পূর্ণভাবে ৬টি ঐশ্বর্য সমন্বিত৷ ঐ সমস্ত ঐশ্বর্য অন্যকে আকর্ষণ করে- আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হবার এটিই রহস্য৷ কারও যে-পরিমাণে এই ঐশ্বর্য থাকে, তিনি ততটাই আকর্ষণীয় হন৷ এজগতে সকলেরই ঐসব ঐশ্বর্য কিছু কিছু পরিমাণে রয়েছে- কিন্তু কেউই সমগ্র ঐশ্বর্য-সম্পন্ন নয়৷ অনেক ব্যক্তি রয়েছেন যাঁরা অত্যন্ত ধনবান, খুব বলবান, খুব রূপবান, অত্যন্ত য্শস্বী, খুব জ্ঞানী এবং অত্যন্ত বৈরাগ্যবান, কিন্তু কেউই দাবী করতে পারে না যে তাঁর সমগ্র ধনৈশ্বর্য , সমগ্র বলবত্তা, সমগ্র সৌন্দর্য ইত্যাদি রয়েছে- একমাত্র ভগবানেরই এগুলি পূর্ণমাত্রায় রয়েছে৷ উপরোক্ত ছয়টি ঐশ্বর্য যাঁর পূর্ণ মাত্রায় আছে, তিনি নিশ্চয়ই 'সর্বাকর্ষক'৷ সংস্কৃত ভাষায় সর্বাকর্ষক শব্দের সমতুল শব্দ হচ্ছে 'কৃষ্ণ'৷
এইভাবে আমরা দেখতে পাই যে, শ্রীকৃষ্ণই একমাত্র পুরুষ, যিনি শাশ্বত কাল ধরে, সম্পূর্ণভাবে সমস্ত ঐশ্বর্যের অধিকারী ৷ শ্রীকৃষ্ণই পূর্ণ ঐশ্বর্যসম্পন্ন পরমপুরুষ, পরমেশ্বর ভগবান৷ পূর্ণ মাত্রায় ঐশ্বর্য সমূহের অধিকারী হওয়ায় শ্রীকৃষ্ণ পরম আকর্ষক, তিনি সর্বাকর্ষক পরম পুরুষ, সেজন্যই তাঁর নাম 'কৃষ্ণ', যিনি সকলকে আকর্ষণ-পূর্বক আনন্দ প্রদান করেন৷
শ্রীকৃষ্ণ : পরম সম্পদশালী
ভগবদ্ গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেন (১০/৮),
"আমি জড় ও চেতন জগতের সব কিছুর উৎস৷ সব কিছু আমার থেকেই প্রবর্তিত হয়৷ সেই তত্ত্ব অবগত হয়ে পণ্ডিতগণ শুদ্ধ ভক্তি সহকারে আমার ভজনা করেন৷"
শ্রীকৃষ্ণ সব কিছুর পরম উৎস হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই তিনি জড় ও চিন্ময় জগতের সব কিছুর উৎস৷
এই জগতে সকলেই লক্ষ্মীদেবীর সামান্য কৃপাদৃষ্টি লাভের জন্য চেষ্টা করছে, কিন্তু চিন্ময় জগতে শতসহস্র লক্ষ্মীদেবী শ্রীকৃষ্ণের সেবা করার জন্য সর্বদা তৎপর, ব্রহ্মসংহিতায় যেমন তা বলা হয়েছে (৫/২৯), "লক্ষ্মী সহস্র শতসম্ভ্রম সেব্যমানম্"৷
ব্রহ্মসংহিতার ঐ শ্লোকেই শ্রীকৃষ্ণের আবাস গোলোকের বর্ণনা দিয়ে বলা হয়েছে যে তার ভূমি চিন্তামণিময় এবং সমস্ত ব্রহ্মগুলিই কল্পবৃক্ষ, সমস্ত গাভীই সুরভী গাভী : চিন্তামণি প্রকরসদ্মসু কল্পবৃক্ষ/ লক্ষাবৃতেষু সুরভিরভি পালয়্ন্তম্৷
এই পৃথিবীতে লীলাবিলাসকালে শ্রীকৃষ্ণ য্খন দুরাচারী নরকাসুরকে বধ করেন, তখন তার কারাগৃহে বন্দী ১৬০০০ রাজকন্যা তাদেরকে গ্রহণ করার জন্য তাঁর কাছে পার্থনা করে৷ শ্রীকৃষ্ণ তাঁদের পার্থনা পূর্ণ করে তাদের সকলকে দ্বারকায় নিয়ে যান এবং প্রত্যেকের জন্য একটি করে অত্যন্ত সুরম্য বিশাল অট্টালিকার ব্যবস্থা করেন, এইরকম প্রত্যেক প্রাসাদে ছিল শোভাময় মোজেইক-রাস্তা, সুন্দর উদ্যান, হাজার হাজার দাস-দাসী, মণি-রত্নখচিত অনন্যসুন্দর আসবাবপত্র৷
বৈকুণ্ঠ জগতের গ্রহলোকগুলিতে ঐরকম কোটি কোটি অতিসুরম্য অট্টালিকা ও মহা-ঐশ্বর্য বিদ্যমান, এবং শ্রীকৃষ্ণই সকল ঐশ্বর্যের অধীশ্বর৷